“প্রিম্যাচিউর হিরো”
একজন প্রিম্যাচিউর বাচ্চার মায়ের জিজ্ঞাসা থেকে আজকের টপিকটা লিখলাম। মা জিজ্ঞেস করছিলেন,”আমার বেবিটা মাত্র ৩০ সপ্তাহে জন্ম নিয়েছে, ও কি অন্য মানুষের মত স্বাভাবিক ভাবে বড় হবে,ও কি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে? আমি জানি অনেক মায়ের এই প্রশ্নটা আছে! আমি কিছু উদাহরণের মাধ্যমে লেখাটি শেষ করতে চেয়েছি,আশাকরি উত্তর পেয়ে যাবেন।
লেখার শুরুর প্রথমে জানবো প্রিম্যাচিউর শিশু কারা?গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুকে প্রিটার্ম বা প্রিম্যাচিউর শিশু বলা হয়।বাংলাদেশে প্রায় প্রতি তিনজন নবজাতক শিশুর মধ্যে একজন কম ওজন ও প্রিম্যাচিউর নিয়ে জন্মগ্রহন করে।
অনেক ক্ষেত্রে কোন কারন ছাড়াই প্রিম্যাচিউর শিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে।তবে মায়েদের দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যের সমস্যা, যেমন ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ,জরায়ুর সমস্যা,গর্ভাবস্থায় যোনিপথে রক্তপাত বা সংক্রমণ,গর্ভাবস্থায় ড্রাগ,অ্যালকোহল সেবন বা ধূমপান ব্যবহার প্রিম্যাচিউর শিশু জন্মগ্রহণ করার অন্যতম কারন হিসেবে দেখা হয়।এছাড়া যমজ এবং ট্রিপলেট শিশু জন্মগ্রহণ করলেও প্রিম্যাচিউরিটির সম্ভাবনা দেখা যায়।
প্রিম্যাচিউর শিশুরা সাধারণত জন্ম পরবর্তী শ্বাসকষ্ট, হৃদযন্ত্র,পাচনযন্ত্র ও জন্ডিসের সমস্যায় ভুগতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে।তবে সবাই যে এতসব সমস্যায় আক্রান্ত হবে ব্যাপারটি কিন্তু এমন নয়। প্রিম্যাচিউর শিশু ভূমিষ্ঠ হলেই সবাইকে নিওনেটাল ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট (NICU) বা স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিটে(SCBU) রেখে চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।৩৫ সপ্তাহ বা তার কম বয়সী শিশু ও যাদের ওজন ১৮০০ গ্রামের কম, তাদের শারীরিক ও অন্যান্য অবস্হার উপর ভিত্তি করে NICU বা SCBU এ ভর্তি করা হয়।
প্রিম্যাচিউর শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদের মনে নানান প্রশ্ন দানা বাঁধে। তাদের স্বাস্থ্য কেমন হবে, কী ভাবে তারা বড় ও ম্যাচিউর হবে, আগামী দিন গুলোতে তাদের মধ্যে কী উন্নতি দেখা দিবে , নানান সব প্রশ্ন নিয়ে বাবা-মা থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন সবাই দুশ্চিন্তায় থাকেন।
আপনি জেনে খুশি হবেন,এসব শিশুরা একবার পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারলে তারা অন্যান্য শিশুদের মতই জ্ঞান-বিবেকে সমান তালে বেড়ে উঠতে থাকে বরং কোন কোন ক্ষেত্রে অন্যান্য শিশুদের চেয়েও জ্ঞান-বিবেকে এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে ।আজ প্রিম্যাচুউর শিশুদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা নয়, বরং আলোচনা করবো প্রিম্যাচুউর হিরোদের নিয়ে ইনশাআল্লাহ।
এখানে বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির নাম তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যারা ভূমিষ্ঠ হয়েছিল প্রিম্যাচিউর অবস্থায়। প্রিম্যাচিউর ভূমিষ্ঠ হয়ে অবিশ্বাস্য প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে অনেক মনীষি জ্ঞান বিজ্ঞানে পৃথিবীতে নাম করে গেছেন। এবং তাদের অসামান্য অবদানের জন্য আজও বিশ্ব তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
ওয়ায়দি ভ্যান নিকার্ক ২৯ সপ্তাহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং জন্মের সময় তার ওজন ছিল মাত্র ১কেজি।তার বাবা-মা কখনো ভাবেননি যে তিনি বেঁচে থাকবেন বা ভবিষ্যতে একজন সফল ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠবেন। রিও ২০১৬ অলিম্পিক গেমসে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জিতে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন৷ তিনি পুরুষদের ৪০০ মিটার ইভেন্টে ৪৩.০৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে আগের গড়া বিশ্ব রেকর্ডটি ভেঙে দিয়েছিলেন৷
স্টিভি ওয়ান্ডার ১৯৫০ সালে মাত্র ৩৪ সপ্তাহের গর্ভাবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রিম্যাচুউর শিশুদের চোখে একটি কঠিন রোগ হয়ে থাকে,যার নাম রেটিনোপ্যাথি অফ প্রিম্যাচুরিটি (ROP)।স্টিভি ওয়ান্ডার এই রোগের কারণে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।এতে তিনি দমে যান নাই। একজন শিশু প্রডিজি এবং অত্যন্ত সফল সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তবে রেটিনোপ্যাথি অফ প্রিম্যাচুরিটি (ROP) নাম শুনে আপনি ভয় পেয়ে যাবেন না।আপনার শিশুকে যথাসময়ে পরীক্ষা করে সমস্যা পাওয়া গেলে, চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটি সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়, এবং অন্ধত্বের আশঙ্কাও থাকে না বললেই চলে।
স্যার আইজ্যাক নিউটন ২৫শে ডিসেম্বর,১৬৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জন্মের সময় তার ওজন ছিল মাত্র ৩ পাউন্ড, এবং কয়েক ঘন্টার বেশি তিনি বেঁচে থাকবেন সে আশাও করা হয়নি। তিনি কেবল বেঁচেই ছিলেন না,তার পরিচিতি আজ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের অন্যতম হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত।১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে তার বিশ্ব নন্দিত গ্রন্থ ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা প্রকাশিত হয় যাতে তিনি সর্বজনীন মহাকর্ষ এবং গতির তিনটি সূত্র বিধৃত করেছিলেন। তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন, পৃথিবী এবং মহাবিশ্বের সকল বস্তু একই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।
মার্ক টোয়েন আমেরিকান ঔপন্যাসিক স্যামুয়েল ক্লেমেন্স, যিনি মার্ক টোয়েন নামে বেশি পরিচিত,১৮৩৫ সালের নভেম্বরে মাত্র ৭ মাসের প্রিম্যাচুরিটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার উপন্যাস দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ হাকলবেরি ফিনকে “দ্য গ্রেট আমেরিকান উপন্যাস” বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
স্যার সিডনি পোইটিয়ার হলেন একজন বাহামিয়ান-আমেরিকান অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখক এবং কূটনীতিক। তিনি প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান যিনি সেরা অভিনেতার জন্য একাডেমি পুরস্কার জিতেছিলেন। তিনি মিয়ামিতে সাত মাসের প্রিম্যাচুরিটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বেঁচে থাকবেন বলে আশা করা হয়নি,জন্মের পর তার বাবা-মা দীর্ঘদিন হসপিটালে রেখে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। জোহানেস কেপলার জার্মান জ্যোতির্বিদ এবং গণিতবিদ ১৫৭৪ সালে জন্মেছিলেন মাত্র ৭ মাসে।
এছাড়া স্যার উইনস্টন চার্চিল(যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী),স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন (পদার্থবিজ্ঞানী),আনা পাভলোভা (বিখ্যাত ব্যালেরিনা) প্রিম্যাচিউর অবস্থায় জন্মগ্রহন করেছিলেন,তাদেরকে নিয়ে প্রতিটি পরিবার ছিল দুশ্চিন্তায়।অথচ তারা সমাজে বেঁচে ছিলেন এক একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে।
আপনি বা আপনার পরিবার কোথায় ডেলিভারি করবেন বা করাবেন তা আগে থেকেই ঠিক থাকতে হবে।”সেফ ডেলিভারি” কথাটি মনে রাখতে হবে অর্থাৎ যে হসপিটালে মায়ের ও নবাগত শিশুর সুচিকিৎসা এবং সর্বোচ্চ চিকিৎসা সুবিধার(NICU) ব্যবস্থা আছে।সেফ ডেলিভারির ব্যবস্থা না থাকলে জন্মের পর আপনার শিশুর চিকিৎসার জন্য ট্রান্সপোর্ট করে অন্য হসপিটালে নিতে হতে পারে।এতে অনেক সময় নষ্ট হয়।অ্যাপোলো ইম্পেরিয়াল হসপিটালস্ এর নবজাতক বিভাগ একটি আন্তর্জাতিক মানসম্মত টারশিয়ারি কেয়ার হসপিটালস্।বিশ্বের বিভিন্ন টারশিয়ারি হসপিটালে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিশেষজ্ঞ টীমের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের এনআইসিইউ(NICU)।জন্মের পর শিশুর প্রতিটি মুহুর্ত গুরুত্বপূর্ণ যেটাকে “গোল্ডেন ওয়ান মিনিট” বলা হয়।সেজন্য আপনার নবজাতকের চিকিৎসার ব্যাপারে আমরা একমুহূর্তও নষ্ট করতে চাই না।প্রতিটি ডেলিভারিতে আমাদের বিশেষজ্ঞ টীম উপস্থিত থাকেন।আমাদের এনআইসিইউ বাংলাদেশের অন্যতম সেরা একটি এনআইসিইউ।প্রিম্যাচুউর শিশুর আউটকামের দিক থেকে আমরাই সেরা।আরেকটি কথা না বললেই নয়,আমাদের আছে” ক্রিটিকাল বেবি ট্রান্সপোর্ট” সুবিধা।বিশেষজ্ঞ টীমের সমন্বয়ে গঠিত এই টীম এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সফলভাবে ১০০০এর মত ক্রিটিকাল বেবি ট্রান্সপোর্ট করেছে।
তাহলে আমরা বুঝতে পারছি,অপরিপক্ক বা প্রিম্যাচুউর শিশু ভূমিষ্ট হওয়া কোন পাপ নয়,দুশ্চিন্তা করাও ঠিক নয়।বরং এই শিশুকে সঠিকভাবে পরিচর্যা বা শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মত চিকিৎসা করলে আপনার শিশুও হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের প্রিম্যাচুউর হিরো।
ডা:ফয়সল আহমদ
ডাঃ এটিএম মাহমুদুর রহমান জে এ সিদ্দিকী।
নবজাতক ও শিশু বিভাগ
অ্যাপোলো ইম্পেরিয়াল হসপিটালস্
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ